বানিয়ে বলা কোন গল্প নয় একদম সত্য কথা। রিক্সাচালক মতিন মিয়া কুমিল্লা মেডিকেল হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন ডান পায়ের তীব্র ব্যাথা নিয়ে। দু’দিন আগে অপারেশন করে ডান পায়ের উরুর মাঝখান থেকে নিচের অংশ কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে। কাটা পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে থাকা মতিন মিয়াকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছেন’?
মতিন মিয়া আকর্ণবিস্তৃত হাসি দিয়ে বললেন, ‘ভাল আছি’। পা হারিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়িয়েছেন যে মানুষটি, সে যখন চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ নিয়ে বলে, ‘ভাল আছি’ তখন সবিস্ময় প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক। উত্তরও আসে খুব সহজেই। মতিন মিয়া তার পঙ্গুত্বের বিনিময়ে মুক্তি পেয়েছে এক দুঃসহ যন্ত্রণার হাত থেকে। যে প্রচন্ড পায়ের ব্যথা তাকে ঘুমাতে দেয়নি, এক রত্তি শান্তি দেয়নি সে ব্যাথার উপশম হলো শেষ পর্যন্ত প্রিয় পাটিকে ফেলে দিয়ে। মতিন মিয়ার অসুখটির নাম বার্জারস ডিজিজ ।
জানা গেল মতিন মিয়া একজন ধুমপায়ী। বলা যায় চেন স্মোকার । আর ধুমপানই তাঁর জন্য ডেকে এনেছে এই অভিশপ্ত রোগ। বার্জার্স ডিজিজে কি হয়? রক্তের ধমনীগাত্রের বিভিন্ন স্তরে ইনফ্লামেশান বা প্রদাহ হয়। এই প্রদাহে ফলে ধমনীর লুমেন বা রক্ত চলাচলের পথটি সরু হয়ে রুদ্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্থ হয়ে সংশ্লিষ্ট অঙ্গে গ্যাংগ্রীন হতে শুরু করে। এক সময় শুরু হয় তীব্র ব্যথা । এই রোগে আক্রান্ত হয় মূলত পা। শুরুতে অল্প অল্প ব্যথা হয়। হাঁটাচলা করলে ব্যথা বাড়ে। আবার বিশ্রাম নিলে কিংবা পা ঝুলিয়ে বসলে আরাম হয়। পায়ের আঙ্গুলগুলো ঠান্ডা, অবস এবং নীল হয়ে যেতে থাকে । রোগের পরবর্তী ধাপে ধীরে ধীরে ব্যাথা বাড়তে থাকে। তখন আর বিশ্রামও মানে না। এক দুঃসহ যন্ত্রণাময় নির্ঘুম জীবনের সূত্রপাত হয়। প্রচন্ড এই ব্যথার তীব্রতা শুধু ভুক্তভোগীই জানেন। ধীরে ধীরে পায়ে গ্যাংগ্রীন হতে থাক। অতঃপর পচন শুরু হয়। চোখের সামনে পচতে থাকে পা।
কেন হয়, কাদের হয়? বার্জারস ডিজিজের মূল কারণটি নিশ্চিতভাবে ধরা না পড়লেও এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে এটি শুধুমাত্র ধূমপানের ফলে যেসব রোগ হয় সেগুলোর নাম যে কোন মানুষ এক নিঃশ্বাসেই বলতে পারবেন। কিন্তু এই রোগগুলো কিন্তু ধূমপান না করলেও হতে পারে। যেমন ফুসফুসের ক্যান্সার ধূমপায়ীদের বেশী হলেও অধূমপায়ীরাও এই রোগে আক্রান্ত হন। কিন্তু বার্জারস ডিজিজ একমাত্র রোগ যা অধূমপায়ীদের কখনই হয় না। এই রোগীরা সব সময়ই চেন স্মোকার। এবং এটি শুধুমাত্র পুরুষদেরই হয় । বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, মজুর শ্রেণীর নিম্ন আয় সম্পন্ন মানুষ যারা খালি পায়ে চলাফেরা করেন তাঁদেরই এই রোগটি বেশি হয়। রাশিয়ার ইহুদী সম্প্রদায়ের পুরুষদের মধ্যে এই রোগটি প্রবণতা বেশী থাকলেও এটা সারা বিশ্বেই দেখা যায়। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে। একমাত্র চিকিৎসা পা কেটে ফেলা । বিকল্প কোন চিকিসা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। প্রতি দিনই সারা বিশ্বে অসংখ্য সার্জন এমনি করে পা কাটছেন অসংখ্য বার্জাস অক্রান্ত রোগীর। ধূমপান ছেড়ে দেয়াই এর একমাত্র প্রতিকার। বলা হয়ে থাকে, ‘নো স্মোকিং-নো বার্জারস ডিজিজস’।
শেষ কথা: বার্জারস ডিজিজের নিশ্চত পরিণতি পঙ্গুত্ব । শুধু তাই নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক পা আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ পাটিও আক্রান্ত হতে শুরু করে। এই রোগটির প্রবণতা ইদানিং আমাদের দেশে যথেষ্ট বেড়েছে। আপনি যদি অধূমপায়ী হয়ে থাকেন তাহলে আপনার ভয় নেই। আর যদি ধূমপায়ী হয়ে থাকেন তাহলে মনে রাখবেন বাজারস ডিজিজ শুধুমাত্র ধূমপায়ীদের অসুখ। ধূমপান এখনই ছেড়ে দিন কারণ এটিই একমাত্র প্রতিকার। নতুবা এই সৌখিন নেশার কারণেই আপনার জীবনের স্বাভাবিক গতিময়তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। একটু ধোঁয়ার সুখের জন্য আপনি নিশ্চয়ই আর যাই হোক পঙ্গু হতে চান না? চান কি?
No comments:
Post a Comment